প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বন্ধুগণ, শুভেচ্ছা ও স্বাগতম
গত কয়েকদিন যাবৎ বাংলাদেশে ঘটে যাচ্ছে একের পর এক বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আবরার হত্যার পর সর্বশেষ ভোলার বোরহানুদ্দিনে এক হিন্দু ছেলের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে সৃষ্ট পুলিশ ও কিছু উত্তেজিত জনগণের মধ্যে সংঘর্ষ। একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন মনে হলেও এর পেছনে রয়েছে একদল কুচক্রী মহলের দুরভিসন্ধি ও চক্রান্ত।
দুটো ঘটনাকে কেন্দ্র করেই তারা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার যে ঘৃণ্য নীল নকশা সাজাচ্ছে তা ক্রমেই প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে তারা হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ককে ধবংস করার পায়তারা করছে। তাদের ঘৃণ্য পরিকল্পনাকে বাস্তবে রুপ দিতে তারা ব্যবহার করছে বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম সংগঠন ইস্কনকে।
চক্রান্তকারীরা সমাজের বিভিন্ন স্তরে জাল বিছিয়ে রয়েছে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় কিছু গণমাধ্যমের সংবাদে ও ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। কুচক্রী মহল এসমস্ত ক্ষেত্রকে কাজে লাগিয়ে ইস্কনকে জড়িয়ে যার পর নাই অপপ্রবার ও গুজব ছড়াচ্ছে সাধারণ মানুষের মাঝে। এভাবে বিভ্রান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ফলে, বাংলাদেশের সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তলানিতে পৌছানোর উপক্রম হয়েছে। ইস্কনের মতো একটি শান্তিপ্রিয় ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনের নামে এমন অপপ্রচার ও গুজব নিতান্তই ন্যক্কারজনক। তাই জনসাধারণের স্বার্থে কিছু বিষয়ের স্পষ্টীকরণ জরুরি।
প্রথমত, আবরার হত্যাকাণ্ডে জড়িত অমিত সাহাকে ইস্কনের সদস্য বলে গত ১১ অক্টোবর, ২০১৯ শুক্রবার দৈনিক নয়াদিগন্ত ও দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় “আবরার হত্যার মূলচক্রী অমিত সাহা উগ্রবাদী ইস্কনের সদস্য”- এই শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যা সম্পূর্ণ ভূয়া ও বানোয়াট। তারা কীসের ভিত্তিতে এমন একটি ভূয়া সংবাদ প্রচার করছে, আমরা তার জবাব চাই। অমিত সাহার সাথে ইস্কনের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই এবং কোন কালে ছিলও না। আমরা এ ব্যাপারে আমাদের বিবৃতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রদান করেছি। তাই অমিত সাহা ইস্যুতে ইস্কনকে জড়ানো যে চক্রান্তকারীদের দুরভিসন্ধি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দ্বিতীয়ত, ভোলার বোরহানুদ্দিনে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননা বিষয়ক পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পুলিশ-জনতার সংঘর্ষে হতাহতের ঘপনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পুলিশ ও প্রশাসনের তদন্তে ইতোমধ্যে থলের বিড়াল বেড়িয়ে এসেছে। কে বা কারা এর সাথে যুক্ত ছিল তা-ও গত কয়েকদিনে জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়েছে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ ইস্যুকে কেন্দ্র করেও অপপ্রচারকারী ও গুজব রটনাকারীর ভোলার হামলায় সংশ্লিষ্ট বিপ্লব চন্দ্র শুভকে ইস্কনের সদস্য বলে অপপ্রচার করছে। গত ২৩ অক্টোবর দৈনিক জনকণ্ঠেও এ ইস্যুতে ইস্কনকে জড়ানো হয়েছে; যদিও তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। উল্লেখ্য, বিপ্লব চন্দ্র শুভ ইস্কনের কোন সদস্য নয় এবং এর সাথে ইস্কনের বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা নেই।
দুটো ইস্যুতেই কোনো প্রকার সংশ্লিষ্টতা না থাকা সত্ত্বেও ইস্কনকে জড়ানোর এই চক্রান্ত থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারীরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার জন্য এক পরিকল্পিত ছক কষছেন। বিভিন্ন জনসভায়ও বিভিন্নরকম উস্কানিমূলক বক্তৃতা দিয়ে জনসাধারণকে ক্ষিপ্ত করা হচ্ছে এবং কোনো কারণ না থাকা সত্ত্বেও তারা বাংলাদেশে ইস্কন নিষিদ্ধের দাবি করছে।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ(ইস্কন) একটি অরাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠন। সারাবিশ্ব তথা বাংলাদেশে ইস্কন কখনো কোনো উগ্রপন্থী কাজে জড়িয়েছে তার কোনো নজির নেই। বরং, ইস্কনের প্রতিনিধিগণ জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে একযোগে বৈশ্বিক শান্তিপ্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে। ইস্কন সমগ্র বিশ্বে সমাজসেবা কার্যক্রমের অংশহিসেবে বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ, চিকিৎসা, বস্ত্রদান ইত্যাদি কার্যক্রম করে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, ইস্কন শ্রীচৈতন্যদেবের বৈষ্ণব দর্শনের অহিংস নীতির আদর্শে প্রতিষ্ঠিত। যে নীতিতে এমনকি কেবল মানুষ নয়, সকল জীবের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষা দেয়া হয়েছে- “জীবে সম্মান দিবে জানি কৃষ্ণ অধিষ্ঠান”। যারা সাধারণ প্রাণীকেও হত্যা করে না, তারা কী করে এমন ঘৃণ্য মানবহত্যার মতো কাজে জড়াতে পারে! ইস্কন সর্বদা সর্বধর্ম ও ধর্মমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা ইস্কনের আদর্শের পরিপন্থী। ইস্কন ভক্তরা জানে ও মানে যে, একই স্রষ্টা স্থান ভেদে, ভাষা ভেদে অন্য নামে অন্যের দ্বারা আরাধিত হচ্ছে।
ইতোমধ্যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার হুঁশিয়ারি বিষয়ে “ইস্কন মন্দিরে লোন উল্ফ কায়দায় জঙ্গি হানার ছক! ভারতীয় গোয়েন্দারা সতর্ক করল ঢাকাকেও” শীর্ষক শিরোনামে গত ২৩ অক্টোবর সংবাদ প্রকাশ করে ভারতীয় গণমাধ্যম দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা। এই একই সংবাদ কলের কণ্ঠও একই তারিখে প্রকাশ করে। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের অংশবিশেষ নিম্নরুপ-
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক মাস ধরে আইএসের মতো সংগঠনের বিভিন্ন প্রচার শাখা- ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনসাসনেস(ইস্কন)-কে ‘হিন্দুত্বের প্রতীক’ হিসাবে প্রবার শুরু করেছে। সম্প্রতি ‘উম্মাহ নিউজ’ নামে আইএসের একটি প্রচার চ্যানেলেও ইসকনকে ‘হিন্দুত্বের প্রতীক’ হিসেবে তুলে ধরে আক্রমণ করা হয়েছে। ভারতীয় গোয়েন্দাদের দাবি, আইএস মনোভাবাপন্ন বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর যেসব নথি তাঁরা পেয়েছেন, তা থেকে স্পষ্ট ওই সংগঠনের উপর হামলার ছক কষা হয়েছে। এক গোয়েন্দার কথায়, “সমগ্রিকভাবে ইস্কন ওদের টার্গেট। এখনও পর্যন্ত পাওয়া বিভিন্ন তথ্য যা ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা থেকে আমাদের ধারণা, বাংলাদেশে ইস্কনের কোনও মন্দিরে হামলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে”।
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার এই প্রতিবেদন নিশ্চয়ই চিন্তা ও উদ্বেগের বিষয়। বাংলাদেশের জনগণ বহুকাল ধরে শান্তিপ্রিয়ভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সাথে স্ব-স্ব ধমীয় আদর্শ নিয়েও বাঙালি জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে সহাবস্থান করে আসছে। আজ জঙ্গীবাদ ও উগ্রবাদের করাল থাবায় সেই সম্প্রীতি ধ্বংসের মুখে। তাই অচিরেই এই অপতৎপরতা বন্ধ অপপ্রচারকরীদের বিরুদ্ধে সরকারের কাছে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। সেই সাথে গণমাধ্যম কর্মীদের মধ্যে যারা ভূয়া সংবাদ প্রচার করে জনগনকে উস্কানি দিচ্ছে, যারা সামাজিক গণমাধ্যমে উস্কানিমূলক পোস্ট দ্বারা মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য প্রচার করছে এবং যারা উগ্র বক্তৃতা দ্বারা জনগণকে উস্কানি দিচ্ছে, তাদের সকলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। সেই সাথে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার নিমিত্তে মন্দির ভাঙচুর ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। অধিকন্ত, ইস্কনসহ বিভিন্ন মঠ-মন্দিরে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা প্রদানের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
উপরোল্লিখিত সংবাদমাধ্যমে মিথ্যা সংবাদ ও অপপ্রচারের তথ্যসম্বলিত প্রতিলিপি বিজ্ঞপ্তির সাথে সংযুক্ত করা হলো।
নিবেদক
সত্যরঞ্জন বাড়ৈ
সভাপতি
ইস্কন, বাংলাদেশ