ব্রজে স্থিতৌ গায়কৌ যৌ মধুকণ্ঠ-মধুব্রত।
মুকুন্দ বাসুদেবৌ তো দত্তৌ গৌরাঙ্গ গায়কৌ \
পূর্বে ব্রজে যাঁরা মধুকণ্ঠ ও মধুব্রত নামক গায়ক ছিলেন, তাঁরা মুকুন্দ ও বাসুদেব নামে দত্তকুলে জন্মগ্রহণ করে শ্রীগৌরাঙ্গের গায়ক হয়েছেন। শ্রী বাসুদেব ও মুকুন্দ দত্ত ঠাকুরের কীর্তনে শ্রী গৌর-নিত্যানন্দ স্বয়ং নৃত্য করতেন। চট্টগ্রামের পটিয়া থানার অন্তর্গত ছনহরা গ্রামে তাঁদের শুভ আবির্ভাব হয়। তাঁরা মহাপ্রভুর অতিশয় প্রিয় পাত্র ছিলেন। মহাপ্রভু ও মুকুন্দ সমবয়স্ক ছিলেন। এক সঙ্গে পাঠশালায় অধ্যয়ন করতেন এবং বিবিধ ক্রীড়াদি করতেন। উপনয়নের পূর্বে বাল্যকালে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বাসুদেব দত্তসহ বিদ্যার্থী হয়ে নবদ্বীপে যান, তখন থেকেই মহাপ্রভুর সঙ্গে তাঁদের বন্ধুত্ব। শিশুকাল থেকে শ্রী মুকুন্দ দত্ত কৃষ্ণভাবনায় তন্ময় থাকতেন। প্রভু বাল্যকাল থেকে মুকুন্দের সঙ্গে কৌতুক করতেন। মুকুন্দের ন্যায় পড়তেন, প্রভু ফাঁকি জিজ্ঞাসা করে কেবল বাদানুবাদ করতেন।
পরবর্তীকালে শ্রীবাস ঠাকুরের গৃহে সাতপ্রহরিয়া ভাব প্রকাশের সময় উপস্থিত ভক্তগণ একে একে শ্রীগৌরসুন্দরের করুণা পাচ্ছেন, কিন্তু মুকুন্দকে মহাপ্রভু ডাকছেন না। শ্রীবাস আদি ভক্তগণ দেখলেন প্রভু মুকুন্দকে ডাকছেন না এবং তাঁর অভীষ্ট বর প্রদান করছেন না। শ্রীবাস জিজ্ঞেস করলেন, “মুকুন্দ কি তোমার করুণা থেকে বঞ্চিত থাকবে? তাকে কি তাঁর অভীষ্ট বর প্রদান করবে না?”
মহাপ্রভু বললেন, “ও বেটা খড় জাঠিয়া, আমার কৃপার অযোগ্য। কখনও সে দন্তে তৃণ ধারণ করে, আবার কখনও বা আমায় জাঠি মারে। সে যখন নির্বিশেষ জ্ঞানীর সভায় যায়, তখন সে তাদের সমর্থন করে। আবার যখন ভক্ত সমাজে যায়, তখন প্রেম দেখিয়ে সে কেঁদে গড়াগড়ি দেয়। যারা আমার স্বরূপ অবজ্ঞা করে তারা আমাকে জাঠি মারে। যারা আমার স্বরূপের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করে, তারা আমাকে অত্যন্ত সুখ প্রদান করে। দন্তে তৃণ ধরে কাঁদে এবং স্তুতি করে আবার কখনো আমার স্বরূপের নিন্দা পূর্বক অবজ্ঞা করে, তারা ‘খড় জাঠিয়া’। আমার কৃপা তারা পায় না।”শ্রী বাসুদেব ও মু
শ্রীমুকুন্দ দত্ত প্রভুর এ মনোভাব অবগত হয়ে ভাবলেন, “এ শরীর আর রাখব না। শ্রীগৌরসুন্দরের করুণাবঞ্চিত এ শরীর ধারণ করে কী লাভ।” শ্রীবাস পণ্ডিত মুকুন্দের এ ভাব বুঝতে পেরে মহাপ্রভুর নিকট মুকুন্দের মনোভাব প্রকাশ করলেন।
তখন মহাপ্রভু বলেন, “মুকুন্দ অবশ্যই আমার দর্শন ও কৃপা পাবে, তবে কোটি জন্ম পরে।” কোটি জন্ম পরে প্রভুর দর্শন ও কৃপা পাবে এ কথা মুকুন্দ শ্রবণ করে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে নৃত্য পূর্বক গাইতে লাগলেন। মহাপ্রভুও মুকুন্দের ভক্তিতে আর স্থির থাকতে পারলেন না। ভক্তের প্রেমে চঞ্চল হয়ে তিনি শ্রীবাসকে বলেন, “শ্রীবাস তুমি মুকুন্দকে শীঘ্রই আমার কাছে নিয়ে এসো। ওর কোটি জন্ম হয়ে গেছে, এবার সে আমায় দর্শন করুক।”
মহাপ্রভু তাঁকে বলেন, “তোমার দৃঢ় বিশ্বাস, অকপট শ্রদ্ধা, অত্যন্তিক প্রেম হেতু কোটি জন্ম তিলার্দ্ধেকের মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। তুমি আমার নিত্য প্রিয় পার্ষদ। তোমার কোনো অপরাধ নেই। জগৎকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই আমি এ লীলা প্রকাশ করেছি। বস্তুত তোমার শরীর ভক্তি প্রেমময়। তুমি আমার নিত্য দাস।”
বাসুদেব দত্ত বদ্ধজীবের দুঃখে কাতর হয়ে তাদের সমস্ত পাপ নিয়ে নরক ভোগের জন্য মহাপ্রভুর নিকটে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন, “তুমি তো জগতের তাপিত জীবকে পরিত্রাণের জন্য অবতীর্ণ হয়েছো, তাই আমার মিনতি জগতের সমস্ত জীবের লব্ধ পাপরাশি আমাকে প্রদান করে, তাদের মুক্ত করে তোমার শ্রীচরণতলে আশ্রয় দান করে তোমার সেবা সুখ জনিত পরমানন্দ দান করো। তাতে যদি আমি নরকগামী হই, তবু দুঃখবোধ না করে পরমানন্দ লাভ করব।”
শ্রীমন্ মহাপ্রভু বাসুদেব দত্তের উক্তি শুনে আনন্দে ‘তথাস্তু’ বলে তাঁকে প্রেমালিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন। প্রেমাবিষ্ট হয়ে মহাপ্রভু বলেন,
ব্রহ্মা জীবের তুমি বাঞ্ছিলে নিস্তার।
বিনা পাপভোগে হবে সবার উদ্ধার \
অসমর্থ নহে কৃষ্ণ, ধরে সর্ব বল।
তোমাকে বা কেনে ভুঞ্জাইবে পাপফল?
তুমি যাঁর হিত বাঞ্ছ, সে হৈল বৈষ্ণব।
বৈষ্ণবের পাপ কৃষ্ণ দূর করে সব \
(চৈ.চ. মধ্য ১৫/১৬৭-১৬৯)
শ্রীমন্মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের পরে গৌরের যতেক ভক্ত পরিকর দিকে দিকে মহাপ্রভুর সংকীর্তন আন্দোলন বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় বাসুদেব দত্ত পশ্চিমবঙ্গে নবদ্বীপের অন্তর্গত কুমারহট্টের নিকটে কাঞ্চনপল্লীতে (কাঁচড়াপাড়ায়) বাস করতেন এবং শ্রীল বৃন্দাবন দাস ঠাকুরের আবির্ভাবভুমি মামগাছিতে মদনগোপাল বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। মহাপ্রভু অন্তর্ধানের পর জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমা তিথিতে শ্রীক্ষেত্রে মুকুন্দ দত্ত লীলা সংবরণ করেন।
বাসুদেব দত্ত সম্পর্কে শ্রীমন্ মহাপ্রভুর উক্তি-
“আপনে শ্রীগৌরচন্দ্র বলে বার বার।
এ শরীর বাসুদেব দত্তের আমার \
দত্ত আমা যথা বেচে, তথাই বিকাই।
সত্য সত্য ইহাতে অন্যথা কিছু নাই \
(চৈ. ভা. অন্ত্য ৫/২৭-২৮)
ছনহরা গ্রামে এখনো তাঁদের জীর্ণ ভিটা দেখা যায়। এখানে বাসুদেব ও মুকুন্দ দত্তের সেবিত বারোটি শালগ্রাম শিলা সেবিত হচ্ছে। পরবর্তীতে তাঁরা কিছুদিন মেখল গ্রামে অবস্থান করেন, সেখানে তাঁদের ভজনকুটির দর্শনীয়।
পথনির্দেশ
চট্টগ্রাম শহর থেকে কক্সবাজারগামী বাসে পটিয়া নামতে হবে। সেখান থেকে সাত কিলোমিটার দূরে ছনহরা গ্রাম।
আরো তীর্থ স্থান দেখতে ক্লিক করুন>>