খেতুরী ধাম-শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর

খেতুরী ধাম (শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর)

রাজশাহী জেলাধীন গোদাগাড়ী উপজেলার অন্তর্গত ৬নং কাঠামাটি ইউনিয়নে খেতুরীধাম অবস্থিত। খেতুরী বৈষ্ণবাচার্য শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুরের আবির্ভাব স্থান। খেতুরী সম্বন্ধে ভক্তিরত্নাকরে উল্লেখ করা হয়েছে-

অতি বৃহদ্ গ্রাম শ্রীখেতুরী পুণ্য ক্ষিতি।
মধ্যে মধ্যে নামান্তর অপূর্ব বসতি \
রাজধানী স্থান সে গোপালপুর হয়।
ঐছে গ্রামনাম ধনাঢ্য বৈসয় \ (ভক্তিরত্নাকর ৪৮২-৪৮৩)

পঞ্চদশ শকাব্দের মধ্যভাগে মাঘী পূর্ণিমার পুণ্যতিথিতে শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর খেতুরী ধামে আবির্ভূত হন।

মাঘী পূর্ণিমায় জন্মিলেন নরোত্তম।
দিনে দিনে বৃদ্ধি হইলেন চন্দ্রসম \

 

শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর
শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর

নরোত্তমের পিতৃদেব ছিলেন গোপালপুর পরগণার অধিপতি রাজা কৃষ্ণানন্দ দত্ত, জননী নারায়ণী দেবী। পুত্র পেয়ে মাতা-পিতা আনন্দে আত্মহারা হন। পুত্র জন্মমাত্রই তারা ব্রাহ্মণদের দ্বারা বেদমন্ত্র পাঠ এবং বিবিধ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান ও বাদ্য-গীতের আয়োজন করেন। শিশুপুত্রের বয়স ছয়মাস হতেই শুভক্ষণে অন্নপ্রাশন সু-সম্পন্ন হয়।

শুভক্ষণে মাতা-পিতা অন্নদিলা মুখে।
ব্রাহ্মণ ভোজন করাইলেন বড় সুখে \
কুটুম্ব ভোজন বহু সংহট্ট করিলা।
যাকে যেই উপযুক্ত ধন বিলাইলা \
পঞ্চ বৎসর হইলে তাঁর কর্ণে ছিদ্র করি।
পরিবার কালে তাঁর হাতে দিলা খড়ি \

পুত্র নরোত্তমের বয়স যখন দ্বাদশ বছর তখন পুত্রের রূপ দেখে মাতা-পিতা আনন্দে আত্মহারা হন। কিন্তু নরোত্তম বাল্যকাল থেকেই ছিলেন সংসারের প্রতি অনাসক্ত।

নরোত্তম ক্রিয়া কহিতে কি পারি।
সর্বতীর্থ দর্শি আকুমার ব্রহ্মচারী \
আকুমার ব্রহ্মচারী সর্বতীর্থদর্শি।
পরমভাগবতোত্তম শ্রীল নরোত্তম দাস \
(ভক্তিরত্নাকর ১/২৭৮-২৭৯)

পিতা-মাতা নরোত্তমের সংসারে ঔদাসীন্যভাব দর্শন করে বিবাহ দিতে মনস্থির করেন। বিবাহের কথা শুনে শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুরের মনে দুঃখাহত হন। সে রাতেই শ্রীমন্নিত্যানন্দ প্রভু তাঁকে স্বপ্নে দর্শন দান করেন। পদ্মায় যে কৃষ্ণপ্রেম সঞ্চিত আছে সেই বৃত্তান্ত বলে পদ্মায় স্নানের আদেশ দেন।

একবার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কানাইনাটশালা গ্রামে নৃত্য-কীর্তন করতে করতে হঠাৎ নরোত্তমের নাম ধরে ডাকতে থাকেন। প্রেমাবেশে মহাপ্রভুর মন অস্থির হয়। শ্রীমন্নিত্যানন্দ প্রভুর সঙ্গে পরামর্শ করে পদ্মা তীরে গড়েরহাটে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সংকীর্তন করতে করতে সেই স্থানে এসে স্নান করার পর পদ্মাবতীর কাছে প্রেম রেখে দেন।

প্রভু কহে পদ্মাবতী ধর! প্রেম লহ।
নরোত্তম নামে পাত্র প্রেম তারে দিও \
নিত্যানন্দ সহ প্রেম রাখিলা তোমা স্থানে।
যত্ন করি ইহা তুমি রাখিবা গোপনে \
পদ্মাবতী বলে প্রভু করো নিবেদন।
কেমনে জানিব কার নাম নরোত্তম \
যাহার পরশে তুমি অধিক উছলিবা।
সেই নরোত্তম-প্রেম তারে তুমি দিবা \

যে স্থানে নরোত্তম দাস ঠাকুর প্রেম লাভ করেছিলেন, সেই স্থান পরবর্তীকালে প্রেমতলী নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে। নরোত্তম নিত্যানন্দ প্রভুর আদেশের কথা চিন্তা করে প্রাতঃকালে একাকি পদ্মাতীরে উপনীত হন।

স্নান করিবারে আসি জলে উত্তারিলা।
চরণ পরশে পদ্মাবতী উন্মিলিলা \

পদ্মা নদী-খেতুরী ধাম
পদ্মা নদী-খেতুরী ধাম

তখন মহাপ্রভুর আজ্ঞা স্মরণ করে পদ্মাবতী নরোত্তমকে প্রেম সমর্পণ করেন। কৃষ্ণপ্রেম প্রাপ্তির পর নরোত্তমের গাত্রবর্ণ পরিবর্তিত হয়। তিনি কৃষ্ণপ্রেম তরঙ্গে ভাসতে থাকেন। তাঁর এ ভক্তিভাব দেখে সকলেই অবাক হন।
পিতা-মাতা গৃহে তাঁকে দেখতে না পেয়ে ব্যাকুল হয়ে তাঁর খোঁজ করতে লাগেন। খুঁজতে খুঁজতে পদ্মার তীরে উপনীত হতেই এক গৌরবর্ণ বালককে দেখতে পান। সেই বালকটি কৃষ্ণপ্রেমে নিমগ্ন হয়ে হরিনাম সংকীর্তন করছিল। কিছুক্ষণ পর নরোত্তম পিতা-মাতাকে প্রণাম করলে পুত্রকে দেখতে পেয়ে পিতা-মাতা স্বস্তি ফিরে পান।

একদিন সঙ্গোপনে নরোত্তম দাস ঠাকুর তাঁর মাতার কাছে বৃন্দাবনে যাওয়ার কথা ব্যক্ত করেন। সে কথা শুনেই মাতা দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে পড়েন। পিতা-মাতা তাঁকে বিবাহ দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। একদিন সবাই যখন রাজকার্যে ব্যস্ত ছিলেন- নরোত্তম দাস কৃষ্ণপ্রেম তরঙ্গে উন্মত্ত হয়ে গৃহবন্ধন ছিন্ন করে বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। প্রেমাবিষ্ট হয়ে শ্রীল ঠাকুর মহাশয় বৃন্দাবনে এসে উপনীত হন এবং চৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদবৃন্দের করুণা লাভ করেন। বিশেষকরে শ্রী জীব গোস্বামীর কাছে শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন এবং লোকনাথ গোস্বামীর কাছ থেকে মন্ত্র দীক্ষা গ্রহণ করেন।

শ্রাবণ পূর্ণিমা তিথিতে শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুরের দীক্ষা হয়। শ্রীজীব গোস্বামী, শ্রীসনাতনাদির অপ্রকটের পর তিনি উড়িষ্যা, বঙ্গদেশ এবং মথুরা মণ্ডলের গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সর্বশ্রেষ্ঠ আচার্য পদে অধিষ্ঠিত হন। বৃন্দাবনে শ্রীল জীব গোস্বামী পাদের আশ্রমে শ্রীনিবাস, নরোত্তম ও শ্যামানন্দ প্রভু একই সঙ্গে শাস্ত্র অধ্যয়ন সু-সম্পন্ন করেছিলেন। শ্রীল জীব গোস্বামী শ্রীনিবাস, নরোত্তম ও দুঃখী কৃষ্ণ দাসকে যথাক্রমে ‘আচার্য’, ‘ঠাকুর’ ও ‘শ্যামানন্দ’ নাম প্রদান করে বঙ্গদেশে (গৌড়) নামপ্রেম প্রচারের জন্য ‘গোস্বামী গ্রন্থ’ সহ প্রেরণ করেছিলেন।

শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর
শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর

শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর খেতুরী ধামে বিবিধ আলৌকিক লীলা প্রকাশ করেছিলেন। খেতুরী থেকে এক ক্রোশ দূরে ভজনতলিতে ঠাকুর মহাশয়ের আশ্রম ছিল। শ্রীল ঠাকুর মহাশয় কীর্তনের দ্বারাই প্রচার করেছিলেন। ঠাকুর মহাশয় ‘গড়াণ হাটী’ নামে কীর্তনের অপূর্ব সুর প্রবর্তন করেছিলেন। তাঁর রচিত ‘প্রার্থনা’ ও ‘প্রেমভক্তি চন্দ্রিকা’ ভক্তগণের প্রাণস্বরূপ। ধারণা করা হয় এ গ্রন্থদ্বয় ভজনতলিতেই রচিত হয়েছিল।

বর্তমানে খেতুরীতে নরোত্তম দাস ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহগণ আর নেই। ১৯৭১ সালে পাক-সেনারা এ শ্রীপাটের ওপর অনেক অত্যাচার করেছিল। যুদ্ধের পরে নিকটস্থ পুষ্করিনীতে নরোত্তম দাস ঠাকুরের সেবিত কয়েকটি শালগ্রাম শিলা পাওয়া গেলেও সেই ছয় বিগ্রহকে আর পাওয়া যায় নি। ১৯৭১-এর যুদ্ধ পরবর্তীকালে স্থানীয় লোকেরা কমিটি করে এখানে কয়েকটি মন্দির তৈরী করে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিবছরই কার্তিক মাসের কৃষ্ণা পঞ্চমী তিথিতে শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর এর তিরোভাব তিথিতে বিশাল মহোৎসব ও মেলা হয়।

শ্রীপাট থেকে কিছুটা উত্তরে ১ ক্রোশ দূরে নরোত্তম দাস ঠাকুর ও রামচন্দ্র কবিরাজ যে স্থানে ভজন-রস আস্বাদন করতেন তা বর্তমানে ভজনতলি নামে প্রসিদ্ধ। সেখানে একটি উঁচু ঢিবি ও তাঁর উপরে একটি অশ্বত্থ বৃক্ষ এবং অদূরে একটি ইমলী বৃক্ষ আছে। শ্রীপাট থেকে অনতিদূরে প্রেমতলী। এখানে প্রাচীন এক তমালবৃক্ষ এবং একটি আশ্রম আছে। এখানে ভগবানের নিত্য সেবা পূজা সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়।

পথনির্দেশ

খেতুরী গ্রামটি রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানায়। রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জগামী বাসে প্রেমতলী নামা যায়। প্রেমতলী থেকে মাইল দু’য়েক দূরে গৌরাঙ্গবাড়ি আশ্রম।

আরো তীর্থ স্থান দেখতে ক্লিক করুন>>

Share on

Facebook
Twitter
LinkedIn