শ্রীল রূপ ও সনাতন গোস্বামী

বাকলা চন্দ্রদ্বীপ (শ্রীল রূপ গোস্বামী ও শ্রীল সনাতন গোস্বামী)

শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের অনুভাষ্যে শ্রীল রূপ ও সনাতন গোস্বামী প্রভুর বংশপরিচয় সম্পর্কে লিখেছেন- “ভরদ্বাজ গোত্রীয় জগদ্গুরু, ‘সর্বজ্ঞ’ নামক একজন মহাপন্ডিত দ্বাদশ শতাব্দে কর্ণাটদেশে ব্রাহ্মণ-রাজবংশে আবির্ভূত হন। তাঁহার পুত্র অনিরুদ্ধের রূপেশ্বর ও হরিহর নামক দু’টি তনয় জন্মে। কিন্তু তাঁহারা উভয়েই রাজ্য হইতে বঞ্চিত হইলে জ্যেষ্ঠ রূপেশ্বর শিখরভূমিতে বাস করেন। রূপেশ্বরের পুত্র পদ্মনাভ গঙ্গাতীরের নৈহাটি নামক স্থানে বাস করিয়া পাঁচটি পুত্র লাভ করেন। তন্মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ মুকুন্দের পুত্র মহা-সদাচারী কুমারদেব বাকলা চন্দ্রদ্বীপে বাস করেন। তিনি-ইসনাতন, রূপ ও অনুপমের জনক।

শ্রীভক্তিরত্নাকরে (১/৫৬৪-৫৬৫) বর্ণিত আছে-

জ্ঞাতিবর্গ হইতে উদ্বেগ হৈল মনে।
ছাড়িলেন নবহট্ট গ্রাম সেইক্ষণে \
নিজ গণসহ বঙ্গদেশে শীঘ্র গেলা।
‘বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ’ গ্রামেতে বাস কৈলা \

বাকলা চন্দ্রদ্বীপেই শ্রীল সনাতন গোস্বামী ১৪৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ও  শ্রীরূপ গোস্বামী ১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দে আবির্ভূত হন। অনুপম বা বল্লভের জন্মের অল্পকাল পরেই পিতা কুমারদেব অপ্রকট হলে পিতামহ তাদের রামকেলি গ্রামে গিয়ে বিদ্যাশিক্ষা করতে বলেন। শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের অনুভাষ্যে রামকেলিকেই শ্রীল জীব গোস্বামীর আবির্ভাব স্থান বলে উল্লেখ করেছেন।

ছোটবেলা থেকেই তিন ভাই সর্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। তাঁরা বালকসুলভ খেলাধুলায় মগ্ন না হয়ে শ্রীমদ্ভাগবতের রসে ডুবে থাকতেন। এ সময় তাঁদের মহিমা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়লে, তৎকালীন গৌড়ের বাদশাহ হুসেন শাহ্ তাঁদের রাজ্যের মন্ত্রীত্ব গ্রহণের প্রস্তাব করেন।

তাঁরা মুসলমান নবাবের ভয়ে মন্ত্রীত্ব গ্রহণে বাধ্য হন। হুসেন শাহ্ প্রধানমন্ত্রী পদে শ্রী সনাতনকে, অর্থমন্ত্রী পদে শ্রীরূপকে এবং টাকশালের অধ্যক্ষরূপে শ্রীবল্লভকে নিযুক্ত করেন। তাদের বুদ্ধিমত্তায় গৌড়রাজের রাজ্য দিন দিন বিস্তৃত হতে থাকে। সে সময় কেউ মুসলমান নবাবের অধীনে চাকরি করলে তাঁদের জাতিচ্যুত করা হতো। শ্রীসনাতনের বাল্যনাম ছিল অমর, হোসেন শাহ্ তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘শাকর মল্লিক’, শ্রীরূপ গোস্বামীপাদের নাম দেন ‘দবির খাস’ – ব্যক্তিগত সচিব (প্রাইভেট সেক্রেটারি) আর অনুপমের নাম হয় ‘অনুপম মল্লিক’।

শ্রীল রূপ গোস্বামী ও সনাতন গোস্বামী
শ্রীল রূপ গোস্বামী ও সনাতন গোস্বামী

রূপ-সনাতন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর চরণ প্রাপ্তির আশায় রাজকার্য পরিত্যাগ করেন ও পরিবারের অন্য সদস্যদের চন্দ্রদ্বীপ ও ফতেয়াবাদে প্রেরণ করেন। শ্রীরূপ ও অনুপম কিছু ধনসম্পদ রামকেলিতে সনাতনের জন্য গচ্ছিত রেখে সবকিছু নৌকায় নিয়ে ফতেয়াবাদে (যশোরের প্রেমবাগে) আসেন। সম্পদের অর্ধেক বৈষ্ণব ও ব্রাহ্মণের জন্য, বাকি অর্ধেকের অর্ধেক ভাগ আত্মীয়দের জন্য ও অন্য অর্ধেক ভাগ আপদ কালীন বিপদের জন্য রেখে দেন। শ্রীজীব গোস্বামী বাকলাতেই বড় হন। সেখানে তিনি সংকীর্তনে মগ্ন হন ও সপার্ষদ শ্রীমন্মহাপ্রভুর দর্শন লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি এ স্থান থেকে নবদ্বীপে যান।

রূপ-অনুপম প্রয়াগে এসে মহাপ্রভুর সাথে মিলিত হন। তাঁরা দূর থেকে তাঁকে দণ্ডবৎ প্রণতি নিবেদন করেন। মহাপ্রভু দশাশ্বমেধ ঘাটে শ্রীরূপকে নিয়ে গিয়ে দশদিন ধরে কৃষ্ণতত্ত্ব, ভগবদ্ভজনতত্ত্ব ও সম্বন্ধতত্ত্ব বিশদভাবে শিক্ষা দেন। ইতোমধ্যেই সনাতন কারারক্ষীকে উৎকোচ দিয়ে মুক্ত হয়ে কাশীতে মহাপ্রভুর সাক্ষাৎ লাভ করেন। দু-মাস শিক্ষা লাভ করে সনাতন রাজপথ দিয়ে মথুরায় গমন করেন।

শ্রীমন্মহাপ্রভু এই দুই ভাইয়ের দ্বারা কতকগুলো বিশেষ কার্য সম্পাদন করেন- জগতে শুদ্ধভক্তির সিদ্ধান্ত স্থাপন, শ্রীব্রজমÐলে লুপ্ততীর্থ উদ্ধার, শ্রীকৃষ্ণসেবা প্রকাশ ও বৈষ্ণবস্মৃতি প্রচার।

শ্রীরূপ গোস্বামী শ্রী গোবিন্দদেব ও শ্রীবৃন্দাদেবীকে প্রকট করেন। আর সনাতন গোস্বামী শ্রীমদনমোহনকে প্রাপ্ত হন এবং তাঁর জন্য সুরম্য মন্দির নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে জীব গোস্বামীও নিত্যানন্দ প্রভুর আদেশে বৃন্দাবনে এসে শ্রীরূপ গোস্বামীর কাছ থেকে শাস্ত্রানুশীলন করেন এবং শ্রীশ্রীরাধা-দামোদরের সেবা প্রকট করেন।

তাঁরা তিনজনই বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তন্মধ্যে শ্রীরূপ গোস্বামীকৃত- ভক্তিরসামৃতসিন্ধু, উজ্জ্বলনীলমণি, লঘুভাগবতামৃত, দানকেলীকৌমুদী; শ্রীসনাতন গোস্বামীকৃত বৃহদ্ভাগবতামৃত, শ্রীহরিভক্তিবিলাস, শ্রীকৃষ্ণলীলাস্তব এবং শ্রীজীব গোস্বামীকৃত- ষটসন্দর্ভ, লঘুবৈষ্ণবতোষণী, সংকল্প কল্পদ্রুম, হরিনামামৃত ব্যাকরণ অন্যতম। শ্রীপাদ সনাতন গোস্বামী ১৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ও শ্রীরূপ গোস্বামী ১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দে অপ্রকট হন।

বৈষ্ণব-আচার্য শ্রীল রূপ গোস্বামী, শ্রীল সনাতন গোস্বামী ও শ্রীল অনুপমের আবির্ভাবস্থান বাকলা চন্দ্রদ্বীপ বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল জেলায় অবস্থিত। শ্রীল চন্দ্রশেখর আচার্যও এ দ্বীপে বাস করতেন। তবে শ্রীল রূপ গোস্বামী ও সনাতন গোস্বামী বা ওই পরিবারের কোনো স্মৃতিচিহ্ন দেখা যায় না। এখানে এখনো প্রাচীন রাজবাড়ির একটি দালান ঘর আছে। রাজা দিলীপকুমার স্ত্রী-পুত্রাদি নিয়ে বসবাস করতেন। এ ছাড়া তৎকালীন একটা মন্দির জীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।

পথনির্দেশ

বরিশাল সদর বাসস্ট্যান্ড থেকে বানারীপাড়া/স্বরূপকাঠিগামী বাসে মাধবপাশা বাজারে নেমে ৫ মিনিট হাঁটলে এই বাকলা চন্দ্রদ্বীপে যাওয়া যায়।

আরো তীর্থ স্থান দেখতে  ক্লিক করুন>>

Share on

Facebook
Twitter
LinkedIn