পুঠিয়া গঙ্গামাতা গোস্বামিনী

পুঠিয়া (গঙ্গামাতা গোস্বামিনী)

রাজশাহী-নাটোর মহাসড়ক হতে মাত্র এক কিলোমিটার দক্ষিণে রয়েছে পুঠিয়া রাজবাড়ী। এখানে প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ এক জমিদার বংশের বাস ছিল। মোঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫) এ জমিদারির উদ্ভব। এ বংশের পূর্বপুরুষ বৎসাচার্য ষোড়শ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগে নিকটবর্তী এক গ্রামে ধর্মসাধনায় লিপ্ত ছিলেন; তাঁর শাস্ত্রজ্ঞান ও সাধুচরিত্রের কথা সর্বত্র প্রসিদ্ধ ছিল।

পুঠিয়া রাজবাড়ী
পুঠিয়া রাজবাড়ী, রাজশাহী

একসময় শ্রীনিবাস আচার্যের সন্তানগণ এখানে দু’জন বৈষ্ণব প্রেরণ করেন। তখন এখানকার রাজা ছিলেন রবীন্দ্রনারায়ণ। তিনি শাক্ত মতাবলম্বী ছিলেন। ভক্তদ্বয়ের প্রভাবে তিনি বৈষ্ণবে পরিণত হন। এখানকার জমিদার নরেশ নারায়ণের একমাত্র কন্যা শচী শিশুকাল থেকেই ভগবদ্ভক্তি পরায়ণা ছিলেন। পুঠিয়া রাজ্যের রাজকন্যারূপে শচীদেবী বা গঙ্গামাতা গোস্বামিনী এ স্থানে আবির্ভূত হন। পিতা-মাতা শচীদেবী শিশুকাল থেকেই সংসার বিরক্ত ও কৃষ্ণভক্তি পরায়ণা ছিলেন। পিতা-মাতা শচীদেবীকে বিবাহ দেবার জন্য ব্যস্ত হলে তিনি বলেন- তিনি কোনো মরণশীল ব্যক্তিকে পতিরূপে গ্রহণ করবেন না।

গঙ্গামাতা গোস্বামী
শচীদেবী/গঙ্গামাতা গোস্বামিনী

তাঁর কথা জানতে পেয়ে পিতা-মাতা চিন্তিত হন। কালক্রমে শচীদেবীর মাতা নিত্যধাম প্রাপ্ত হলে তিনি বৃন্দাবনে গোবিন্দ জীউ মন্দিরের সেবাধ্যক্ষ হরিদাস পণ্ডিতের দর্শন লাভ করে কৃতকৃতার্থ হন। তাঁর কাছে মন্ত্র দীক্ষা লাভের জন্য ব্যাকুল হলে হরিদাস পণ্ডিত গোস্বামী ঠাকুর তাঁকে রাজকন্যা জেনে প্রথমে দীক্ষা দিতে অস্বীকার করেন। পরে শচীদেবীর বৈরাগ্য ও ভজনার্ত্তি দেখে দীক্ষা দিতে সম্মত হন।

শচীদেবী কয়েক বছর রাধাকুণ্ডে অবস্থানের পর হরিদাস গোস্বামী ঠাকুর তাকে পুরুষোত্তম ধামে সার্বভৌমের স্থান উদ্ধারের জন্য পাঠিয়ে দেন। গুরুআজ্ঞা শিরোধার্য করে শচীদেবী পুরুষোত্তম ধামে ক্ষেত্রসন্ন্যাস ব্রত ধারণ করে অবস্থান করতে থাকেন। সেই সময় বাসুদেব সার্বভৌমের স্থানটি লুপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। কেবল একটি জীর্ণমন্দিরে বাসুদেব সার্বভৌমের সেবিত শ্রীরাধাদামোদর শালগ্রাম শিলা সেবিত হচ্ছিল।

শচীদেবী বিষয় বিরক্ত হলেও গুরুদেবের আদেশ স্মরণ করে লুপ্ত তীর্থ উদ্ধারের জন্য সেই স্থান গ্রহণ করেন। যেখানে ভগবানের যথার্থ প্রীতি ও ভগবদ্ সেবার্থে স্বার্থবোধ সেখানে কোনো কষ্ট নেই। বরং সেবার সুযোগ সৃষ্টি হলে পরমানন্দ লাভ হয়। শচীদেবী কর্তৃক সার্বভৌম ভট্টাচার্যের স্থানটি উদ্ধার হওয়ায় পুরীতে এ স্থানটি গঙ্গামাতা মঠ নামে বিখ্যাত।

বর্তমানে পুঠিয়ায় ষোলটি মন্দির স্থাপনা আছে। পুঠিয়ার রাজবাড়ির পূর্বমধ্যভাগে পাঁচ আনি গোবিন্দ মন্দির অবস্থিত। মন্দিরটি ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত। এটি পঞ্চরত্ন মন্দির। মন্দিরের চারকোণার রত্ন অপেক্ষা মধ্যবর্তী রত্নটি বৃহৎ। এ মন্দির অভ্যন্তরে নিচতলায় একটি কক্ষ আছে। সেখানে শ্রীগোবিন্দ, শ্রীরাধা, শ্রীগোপাল, শ্রীগৌর-নিতাইয়ের পূর্ণাবয়ব বিগ্রহ কাঠের উঁচু দোলায় বিরাজমান। তবে এই বিগ্রহগুলি নতুন। গোবিন্দ সরোবরের পাশে দোলমঞ্চ, দোলমঞ্চের সামনে শ্রীগোপাল মন্দির ও আহ্নিক মন্দির। এই মন্দিগুলির নিমার্ণশৈলী অতি চমৎকার।

জমিদারের আমলে এই সমস্ত মন্দিরে যথারীতি সেবাপূজা হতো। বর্তমানে মন্দিরগুলো শুধু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। তবে সেই জমিদারদের প্রতিষ্ঠিত শিবসাগর নামক বিশাল পুষ্করিণীর তীরে ভূবনেশ্বর মহাদেবের বিরাট পঞ্চরত্ন মন্দির আছে। এ মন্দিরের শিবলিঙ্গ অত্যন্ত বড়। প্রত্যেক দিন এখানে তাঁর সেবা পূজা সম্পাদিত হয়। শ্রাবণ মাসের শেষ সোমবারে শিবলিঙ্গ গঙ্গাজল অপূর্ণ উপলক্ষে বিশাল উৎসব উদ্যাপিত হয়।

পথনির্দেশ

পুঠিয়া বর্তমান রাজশাহী জেলায় অবস্থিত। রাজশাহী শহর থেকে আনুমানিক ৩০ কি. মি. পূর্বে রাজশাহী-নাটোর মহাসড়কে অবস্থিত এ পুঠিয়া উপজেলা। মহাসড়ক থেকে মাত্র ১ কি.মি. দক্ষিণে রয়েছে পুঠিয়া রাজবাড়ী।

আরো তীর্থ স্থান দেখতে ক্লিক করুন>>

Share on

Facebook
Twitter
LinkedIn