শ্রীল বংশীদাস বাবাজী মহারাজ

মজিতপুর (শ্রীল বংশীদাস বাবাজী মহারাজ)

প্রাক্তন ব্রিটিশ ভারতের পূর্ব বাংলার ময়মনসিংহ জেলার (বর্তমান বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া থানার) মজিতপুর গ্রামে শ্রীল বংশীদাস বাবাজী মহারাজ ১৮৫৯ সালে আবির্ভূত হন।

যদিও তিনি গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর সমকালীন নন, তবুও একজন অন্তরঙ্গ গৌরপার্ষদরূপে গৌড়ীয়দের নিকট সুপরিচিত। বংশীদাস বাবাজী পরমহংস বৈষ্ণব ছিলেন। তাঁর পিতা সনাতন মল­বর্মণ ছিলেন দরিদ্র জেলে। মাতা শ্রী সর্বসুন্দরী দেবী ছিলেন ধর্মপ্রাণা সাধ্বী রমনী। বাংলার আর সাধারণ পরিবারের মতো ভৈরব চন্দ্র (বংশীদাস বাবাজীর পূর্ব নাম) চরম দারিদ্র্যের মাঝে বড় হয়েছিলেন। তাঁর পিতা ও অন্য জেলেদের সাথে তিনি সারাদিন নদীতে পড়ে থাকতেন।

শ্রীল বংশীদাস বাবাজী মহারাজ
শ্রীল বংশীদাস বাবাজী মহারাজ

তিনি বিজয়ার নরোত্তম দাস বাবাজীর কাছ থেকে জড় জীবনের অনিত্যতা, শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণ ও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর লীলাকথা ও হরিনাম মাহাত্ম্য শ্রবণ করতেন। ধীরে ধীরে ভৈরব চন্দ্র অধিকাংশ সময় তাঁর গুরুদেবের আশ্রমে থাকতে শুরু করেন। তাঁর জীবনের প্রতি উদাসীনতা লক্ষ্য করে পিতা জোর করে বিয়ে করিয়ে দেন। তা সত্ত্বেও নববধূ ও ছয় মাসের শিশুপুত্রকে রেখে তিনি সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণ করেন। তাঁর নাম হয় বংশীদাস বাবাজী। মজিতপুরের পঞ্চবটীতে তিন বছর কঠোর তপস্যা করে তিনি নবদ্বীপে যান এবং সেখানেই তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় কাটান।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধারার পরমহংস বাবাজীরা শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ বা বৈধীভক্তিও অনুসরণ করেননি। তাঁরা স্বতঃস্ফূর্ত কৃষ্ণসেবায় যুক্ত থাকেন, কোনো বিধি মানেন না। তাই তাদের বলা হয় অবধূত। অবধূত বাবাজীদের মধ্যেও বংশীদাস বাবাজীর আচরণ অনন্য। তাঁর আচরণ পারমার্থিক সংস্কৃতি দূরে থাক, ভারতীয় কোনো সংস্কৃতির সাথে মেলে না। তাই সাধারণ লোকজন তাঁকে পাগল বলত। তিনি ছিলেন ছয় ফুট লম্বা, স্বাস্থ্যবান। তাঁর চুল-দাড়ি ছিল লম্বা ও অগোছালো। তিনি কখনো স্নান করতেন না। কৌপিন ছাড়া আর কিছুই পরতেন না। জপ, তিলক এমনকি সন্ধ্যা বন্দনাদিও করতেন না। তাঁর একমাত্র সেবা ছিল বিগ্রহগণের সাথে কথা বলা।

প্রকৃতপক্ষে বংশীদাস বাবাজী ছিলেন একজন শ্রীকৃষ্ণের বাৎসল্য রসের শুদ্ধভক্ত। যদিও তিনি ভক্তিসাধনায় কঠোর নিয়ম পালন করতেন না। তথাপি তিনি কখনো বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত থেকে সরে যাননি। শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর বংশীদাস বাবাজীর আচরণকে বৈদিক শাস্ত্রে বর্ণিত সর্বোচ্চ স্তরের বলে নিশ্চিত করেছেন। তাঁদের পরস্পরের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা ছিল। শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর প্রায়শই নবদ্বীপে বংশীদাস বাবাজীর কুটিরে আসতেন। তাঁকে আসতে দেখে বাবাজী বলতেন, “ওই যে! এক মঞ্জরী আসছে। রাধারাণী কি আসবে না? তিনি অবশ্যই আসবেন।

তিনি অবশ্যই আসবেন।” তিনি শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরকে মঞ্জরী বলে অভিহিত করতেন। যখন তাঁকে দর্শন করতে আসতেন শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর তাঁর শিষ্যদের চুপ করে বসে থাকতে বলতেন এবং তাঁর উন্নত ও অস্বাভাবিক আচরণ দেখে প্রমাদবশত যেন কোনো অপরাধ না করে সেজন্য সতর্ক করতেন। এমনকি বাবাজীর সেবা করার জন্য তিনি তাঁর কতিপয় শিষ্য দোলগোবিন্দ ব্রহ্মচারী, যতিশেখর প্রভু, অনন্ত বিশ্বম্ভর প্রভু প্রমুখকে নিয়োগ করেছিলেন।

১৯৪৩ সালের ৫ এপ্রিল বাবাজী পুরীধামের জগন্নাথ মন্দিরের পশ্চিম দ্বারের কাছে ছিলেন। তখন শ্রীপাদ ভক্তিপ্রদীপতীর্থ মহারাজ কিছু ভক্তের সাথে মৃদঙ্গ সহযোগে কীর্তন করছিলেন। কীর্তন শ্রবণান্তে বাবাজী মহারাজ বলেন, “তপ তপ হরি খোল ফাটে বুক ফাটে না।” অর্থাৎ কৃষ্ণনাম সংকীর্তন করতে করতে খোল ফেটে যায়, কিন্তু বুক ফাটে না। তখন তাঁরা নিশ্চুপ হয়ে বাবাজী মহারাজের শ্রীচরণে প্রণতি নিবেদন করে সেখানে বসে পড়ে।

দেহত্যাগের কিছুদিন পূর্বে তিনি মজিতপুরে ফিরে আসেন এবং ২৩ শ্রাবণ শুক্লা চতুর্দশীতে  (২৩ জুলাই ১৯৪৪ সালে) অপ্রকট হন। বর্তমানে মজিতপুরে শ্রীল বংশীদাস বাবাজীর আশ্রমে বাবাজী মহারাজ ও তাঁর সেবকদের সমাধি বর্তমান। মন্দিরে শ্রীশ্রীরাধাগোবিন্দ ও শ্রীশ্রীপঞ্চতত্ত্বের সেবা হয়। অদ্যপি মন্দিরের অদূরে বাবাজী মহারাজের বংশীয়গণ বসবাস করছেন। কাছেই বেবুইদ রাজার পুষ্করিণী নামে খ্যাত একটি বিশাল জলাশয় এবং একটি প্রাচীন মন্দির রয়েছে। স্থানীয়দের মুখে শোনা যায় যে, এ পুকুরে মাঝে মাঝে বাবাজী তাঁর গৌর নিতাই বিগ্রহগণকে স্নান করাতে আসতেন। আর সেই মন্দিরটিতে বাবাজী কিছুদিন অবস্থান করে ভজন করেছিলেন এবং একবার শ্রীশ্রীরাধাগোবিন্দের ঝুলনযাত্রা উৎসব করেছিলেন।

পথনির্দেশ

ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জগামী বাসে কটিয়াদীতে নেমে মজিতপুর যাওয়া যায়। এ ছাড়া ঢাকার মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল থেকে কিশোরগঞ্জগামী বাসে উঠলে মির্জাপুর স্টপেজের কিছু পূর্বে সরাসরি আশ্রমে নামা যাবে।

আরো তীর্থ স্থান দেখতে ক্লিক করুন>>

Share on

Facebook
Twitter
LinkedIn