বৃষভানু মহারাজ তয়াখ্যাতঃ পুরা যে ব্রজমণ্ডলে।
অধুনা পুণ্ডরীকাক্ষো বিদ্যানিধি মহাশয়ঃ \
অর্থাৎ – ব্রজে যিনি বৃষভানু মহারাজ রূপে বিখ্যাত ছিলেন, তিনিই পুণ্ডরীক বিদ্যানিধি মহাশয়রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। প্রসিদ্ধ প্রাণকৃষ্ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের পৌত্র শিবরাম গঙ্গোপাধ্যায়ের তৃতীয় পুত্র, যিনি বরেন্দ্র রাজের রাজ পণ্ডিতরূপে কর্মরত ছিলেন, তিনিই বিদ্যানিধির পিতা বাণেশ্বর পণ্ডিত (মতান্তরে শুক্লাম্বর) এবং তার মাতা হচ্ছেন পরম ধর্মানুরাগী পতিব্রতা গঙ্গাদেবী।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার মেখলা গ্রামে আনুমানিক ১৪৮৫ সালে মাঘ মাসে শ্রীপঞ্চমীর পবিত্র তিথিতে মহীয়ষী গঙ্গাদেবী এক তেজোদ্দীপ্ত দিব্য পুত্রসন্তান প্রসব করেন। পুত্রের নাম রাখা হলো পুণ্ডরীক। শ্রীল বৃন্দাবন দাস ঠাকুর চৈতন্য ভাগবতে বর্ণনা করেছেন :
চাঁটিগ্রামে জন্ম বিপ্র পরম পণ্ডিত।
পরম-স্বধর্ম সর্বলোক-অপেক্ষিত \
কৃষ্ণভক্তি সিন্ধুমাঝে ভাসে নিরন্তর।
অশ্রু-কম্প-পুলক-বেষ্টিত কলেবর \
গঙ্গাস্নান না করেন পাদস্পর্শ ভয়ে।
গঙ্গা দরশন করে নিশার সময়ে \
(চৈ. ভা. মধ্য ৭/২৩-২৫)
শ্রীমন্মহাপ্রভু তাঁর এহেন ভক্তি দেখে, তাঁকে কখনো পুণ্ডরীক প্রেমনিধি, কখনো গুননিধি, কখনো বা বিদ্যানিধি নামে সম্ভাষণ করতেন। পূর্বলীলার স্মরণবশত রোদনপূর্বক মহাপ্রভু যাঁকে উদ্দেশ্য করে পুণ্ডরীক বাপরে বলে আর্তনাদ করতেন, তিনিই পুণ্ডরীক বিদ্যানিধি। তিনি যখন বিদ্যার্থী হয়ে নবদ্বীপে গমন করেন, তখন অলংকার, ন্যায়, ব্যাকরণ শাস্ত্রে এতই সুদক্ষ ছিলেন যে তাঁকে বৈদান্তিক পণ্ডিতগণ বিদ্যানিধি উপাধিতে ভূষিত করেন। মহাপ্রভুর সঙ্গ লাভের নিমিত্তে নবদ্বীপে গিয়ে নিজগৃহে গুপ্তভাবে অবস্থান করেন।
মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণের পর যখন পুরীধামে অবস্থান করতেন, তখন প্রতি বৎসর গৌড়ীয় ভক্তগণের সঙ্গে শ্রীল পুণ্ডরীক বিদ্যানিধি মহাশয়ও পুরীধামে যেতেন। পুরীধামে মহাপ্রভু চন্দনযাত্রার সময় নরেন্দ্র সরোবরে ভক্তসঙ্গে জলকেলিকালে বিদ্যানিধি মহাশয় স্বরূপ দামোদরের সঙ্গে জলকেলি করতেন।
দুই সখা-বিদ্যানিধি, স্বরূপ দামোদর।
হাসিয়া আনন্দে জল দেন পরস্পর \
(শ্রী চৈ. ভা. অন্ত্য ৮/১২৪)
ওড়ন ষষ্ঠীর সময় শ্রীজগন্নাথদেবকে মাড়যুক্ত বস্ত্র পরিধান করানো হয়। বিদ্যানিধি মহাশয়ের এহেন গর্হিত আচার বিশেষ মনপুত হয়নি। তাই তিনি ইতস্তত করতে লাগলেন, ভাবলেন এ আবার কোন দেশে এলাম। সেদিন রাত্রে জগন্নাথ-বলদেবে স্বপ্নে আবির্ভুত হয়ে এহেন দুর্বুদ্ধির জন্য শাসন করেন এবং দুই গালে চড় মারেন। জগন্নাথদেবের নিজ প্রিয়জনের দোষ দেখতে নেই।
সেই রাত্রি জগন্নাথÑবলাই আসিয়া।
দুই ভাই চড়ান তারে হাসিয়া হাসিয়া \
গাল ফুলিল আচার্য অন্তরে উল্লাস।
বিস্তারি বর্ণিয়াছেন বৃন্দাবন দাস \
(চৈ.চ. মধ্য ১৬/৮০-৮১)
শ্রীল বৃন্দাবন দাস ঠাকুর তার শ্রীচৈতন্য ভাগবতের উপসংহার করেছেন-
এ ভক্তের নাম লৈঞা গৌরাঙ্গ ঈশ্বর।
পুণ্ডরীক বাপ বলি কান্দেন বিস্তর \
পুণ্ডরীক বিদ্যানিধি চরিত্র শুনিলে।
অবশ্য তাহারে কৃষ্ণ পাদপদ্ম মিলে \
দীর্ঘদিন বিদ্যানিধির আরাধ্য শ্রীশ্রী লক্ষ্মীজনার্দনের সেবা জগৎচন্দ্র গোস্বামী আদির মাধ্যমে সম্পাদিত হওয়ায় পর যখন একে একে গৌরাঙ্গের গণ নিত্যলীলায় যুক্ত হওয়ার মানসে অন্তর্ধান করেন, তখন এর সেবাও ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে। এরূপ অবস্থায় বর্গিদের আক্রমণের কারণে সেবকগণ শ্রীবিগ্রহকে শ্রীধামস্থ রাধাকুণ্ডে লুকিয়ে রাখেন। দীর্ঘদিন পর স্বপ্নাদেশের নিমিত্তে (বর্তমান চট্টগ্রামের বোয়ালখালিস্থ কানুন গোপাড়ায়) এক আচার্য ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবের মাধ্যমে কালাচাঁদ ঠাকুর রূপে নব নব সেবা ও লীলা প্রকাশ করেন। অদ্যপিও এ দিব্য শ্রীবিগ্রহ যেকোনো মুখগামী করে রাখলেও শ্রীপুণ্ডরীক ধাম অভিমুখী দৃষ্টিস্থাপন করেন। সাড়ে পাঁচশত বৎসর আগে শ্রীল বিদ্যানিধির নিজ প্রতিষ্ঠিত ভজন মন্দির শিলালিপি সমেত অদ্যপি বিদ্যমান। সৌভাগ্যের বিষয় বিদ্যানিধির বংশজাত অধঃস্তন পুরুষ শ্রী কৃষ্ণকিঙ্কর বিদ্যালঙ্কার, যিনি আরাকান রাজার অর্থ উপদেষ্টা ছিলেন, তাঁর মাধ্যমে লোহার বেষ্টনী দ্বারা তা সংস্কার পূর্বক সুরক্ষিত হয়েছে। তিনি সমস্ত সম্পত্তি লক্ষ্মীগোবিন্দ ও লক্ষ্মীজনার্দনের নামে উইল করে যান।
শ্রীধামের সেবা ইস্কনের হাতে সমর্পণের পূর্বে জঙ্গলাকীর্ণ শ্রীধামে বিভিন্ন বৈষ্ণবগণ কর্তৃক সেবা চলে আসছিল। মেখলার শ্রীপাটে পুণ্ডরীক-সেবিত শ্রীশ্রী অর্চাবিগ্রহ লক্ষ্মীগোবিন্দ ও চতুর্দশ শালগ্রাম বিরাজ করছেন।
কালের আবর্তে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে উদ্ধারপূর্বক পুণ্ডরীক বিদ্যানিধি স্মৃতি সংসদ এর ক্রমোন্নতি সাধনের মাধ্যমে বিদ্যানিধির মহিমা তুলে ধরার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার মাধ্যমে, শ্রীযুত মৃদুল কান্তি দে মহোদয়সহ স্মৃতি সংসদের অন্যান্য কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ১৯৮২ সনে শ্রীল জয়পতাকা স্বামী মহারাজের নেতৃত্বে ইস্কন পরিচালক মণ্ডলীর নিকট ধামের সেবা ভার হস্তান্তর করেন এবং তাঁরা উন্নয়ন কার্যে অদ্যাপি সহযোগিতা করে আসছেন। শ্রীধামের দায়িত্ব গ্রহণ পূর্বক শ্রীল জয়পতাকা স্বামী গুরুমহারাজের সন্ন্যাস উত্তর জীবনের প্রথম প্রতিষ্ঠিত শ্রীশ্রীবার্ষভানবীমুরারী ও গৌরসুন্দরের সেবা প্রকাশ করেন। এখানে এখনো পুণ্ডরীক বিদ্যানিধির ভজনকুটির, রাধাকুণ্ড-শ্যামকুণ্ড বিরাজমান। শ্রীপাটের অনতিদূরেই বাসুদেব-মুকুন্দ দত্তের ভজনকুটির দর্শনীয়।
পথনির্দেশ
চট্টগ্রাম থেকে হাটহাজারী গামী বাসে হাটহাজারী স্টপেজে নেমে, সেখান থেকে অটোরিক্সা বা রিক্সাভ্যানে কিছুদূরে মেখল গ্রামের এই শ্রীপাটে আসা যায়।
আরো তীর্থ স্থান দেখতে ক্লিক করুন>>